আওয়াজটা গাড়ির মতো ক্যাঁচ ক্যাঁচ নয়। মৃদু, তবে খ্যাচ খ্যাচ একটা শব্দ। সেটা শুনে খেতে খেতেই মুখ তুলে অতিথির দিকে একটু যেন বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালেন সুচিত্রা সেন। তবে চোখের ভাষায় রোম্যান্টিক ঝিলিক ছিল না, ছিল সামান্য হলেও বিরক্তি।
৫২/৪/১ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেই সাবেক বাড়ির দোতলার ডাইনিং হল-এ চলছে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া। ডাইনিং টেবিলে কাঠের উপর কাচ বসানো। তার উপর দুধসাদা টেবিল কভার। মহানায়িকার কিছুটা কোনাকুনি বসে তাঁর অতিথি। তার একটু আগেই পাতে পড়েছে কুমড়োর ডাঁটা দিয়ে মুগ ডালের চচ্চড়ি। অনেকে ডালে কুমড়ো বা লাউয়ের ডগা ফেলে দিয়ে খান। তবে তার চেয়ে মটর ডাল কিংবা মুগ ডাল দিয়ে ওই শুকনো শুকনো, গা-মাখা রান্নাটা বড়ই উপাদেয় ও সুস্বাদু। সেই পদ যেমন খেতে ভালোবাসতেন ও অন্যকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন, তেমনই নিজে দুর্ধর্ষ রান্না করতেন সুচিত্রা সেন।
কুমড়োর কচি ডগা ও পাতায় এমনিতেই একটু ক্রিস্পি বা মুচমুচে ভাব রয়েছে। রান্নাতেও সেই ভাবটা নষ্ট হয় না। তার উপর অত সুস্বাদু একটি পদ। মহানায়িকার অতিথি স্থান-কাল-পাত্র, থুড়ি পাত্রীর খেয়াল না-করেই ডাঁটা চিবোতে লাগলেন নিজের মতো করে। তখনই ওই খ্যাচ খ্যাচ আওয়াজ এবং খেতে খেতেই মহানায়িকার চোখ তুলে তাকানো অতিথির দিকে।
তীক্ষ্ণ সেই চাউনিতে অতিথির মুখ চলা থেমে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, আওয়াজ করে কুমড়োর ডাঁটা চিবিয়ে তিনি টেবিল ম্যানার বা এটিকেট অর্থাৎ শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেছেন। কুমড়োর ডাঁটা তো মহানায়িকাও চিবোচ্ছেন। কই, তাঁর মুখ দিয়ে তো ডাঁটা চিবোনোর আওয়াজ বেরোয়নি!
অতিথির নাম অমল শূর। তাঁর মুখ তখন কাঁচুমাচু। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হো হো করে হেসে উঠলেন সুচিত্রা সেন। বললেন, ‘আপনি যে ভাবে খাচ্ছিলেন, সে ভাবেই খান। কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আজ না-হয় আমি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন হয়েছি বলে সেই ভাবে থাকি। কিন্তু শুরু থেকেই কি তা ছিলাম? কুমড়োর ডাঁটা এই ভাবে চিবিয়ে না-খেলে মজাই নেই!’
আশ্বস্ত হয়ে ফের খাওয়ায় মন দিলেন অমল শূর।
অমল শূর। উত্তর ফাল্গুনী, মম্তা (হিন্দি), কমললতা, মেঘ কালো এবং আলো আমার আলো— সুচিত্রা সেনের এই পাঁচটি ছবিতে যিনি ছিলেন সহকারী পরিচালক। যিনি ছিলেন মহানায়িকার খুব কাছের এক জন। ১৯৬৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত মহানায়িকার সঙ্গে টানা যোগাযোগ ছিল তাঁর। অধিকাংশের কাছে মহানায়িকা ধরাছোঁয়ার বাইরে হলেও তাঁর বাড়িতে অমল শূরের ছিল এক রকম অবারিত দ্বার। আসলে মহানায়িকার কাছে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছিলেন অমলবাবু। যোগাযোগ তাই বিচ্ছিন্ন হয়নি। সেই জন্য সুচিত্রা সেন সম্পর্কে অমল শূরের দেওয়া তথ্য অবশ্যই প্রামাণ্য। সেই অশীতিপরের কাছ থেকেই জানা গেল সুচিত্রা সেনের রসনা বিলাস নিয়ে চমকপ্রদ সব তথ্য।
মহানায়ক উত্তম কুমারের ভোজন বিলাসের নানাবিধ বিষয় সামনে এসেছে নানা ভাবে। সেই সম্পর্কে বেশির ভাগটা জানা গিয়েছে বিভিন্ন সময়ে সুপ্রিয়া দেবীর কাছ থেকে। তবে খাবার-দাবারে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পছন্দ কেমন ছিল, তা নিয়ে এর আগে খুব বেশি তথ্য সামনে আসেনি। এক প্রবীণ সাংবাদিক যেমন একটি নিউজ় চ্যানেলের স্টুডিয়োয় বসে বারবার কয়েকটা পদই সুচিত্রা সেনের পছন্দের বলে মুখস্থ আউড়ে যেতেন— ভাত, ডাল, ভাজা, চারা পোনা মাছের ঝোল। তার বাইরে আর কিছু বলতেন না, খুব সম্ভবত জানতেনও না। এবং অমল শূর বলছেন, ‘এতগুলো বছর যোগাযোগ ছিল। অন্তত আমি কোনও দিন ম্যাডামকে চারা পোনা মাছ খেতে দেখিনি, কাউকে খাওয়াতেও দেখিনি! তবে সব বাঙালিরই যেমন ভাতের সঙ্গে ডাল ও ভাজা প্রিয়, তেমনই ম্যাডাম খুব পছন্দ করতেন পাতলা মুসুর ডাল, ঝুরো আলুভাজা এবং বেগুন ভাজা— অবশ্য ভাজার বেগুন কাটতে হতো গোল গোল করে।’
আবার ভাতের সঙ্গে ডিম-আলু সিদ্ধ মাখা অনেকেরই প্রিয় খাবার। কিন্তু মহানায়িকা সেটা খেতেন রীতিমতো তরিবত করে। ও সব পোলট্রি-ফোলট্রির ডিমের মতো খেলো ব্যাপার চলবে না, সুচিত্রার চাই খাঁটি দেশি মুরগির কিংবা হাঁসের ডিম। সেই ডিম মাখা হবে নৈনিতাল আলু সিদ্ধর সঙ্গে। এখন যেমন চন্দ্রমুখীর কদর, সেই সময়ে ছিল নৈনিতাল আলু ছিল উঁচু দরের। সেই আলু সিদ্ধ ও ডিম সিদ্ধ মাখার জন্য চাই সরষের তেল। ঘানিতে ভাঙানো খাঁটি সরষের তেল। যা মহানায়িকার বাড়িতে আসত কালীঘাট এলাকার একটি বিখ্যাত ঘানি থেকে। ওই সিদ্ধ মাখার জন্য আর যেটা লাগত, সেটা অবশ্যই নুন এবং সেই সঙ্গে কাঁচালঙ্কা। তা বলে গোল-বেঁটে-পুরু খোসার কম-ঝাল লঙ্কা নয়, সুচিত্রার কাছে অপরিহার্য ছিল লিকলিকে সরু ও পাতলা খোসার কাঁচালঙ্কা। যার স্বাদ ও গন্ধ, দু’টোই ঝাল। ওই দেবভোগ্য ডিম-আলু সিদ্ধ মাখা প্রথম বার খাওয়ানোর সময়ে অমল শূরকে সুচিত্রা সেন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি তো হাত দিয়ে মাখাই। আমি যদি মেখে দিই, তা হলে আপনি খাবেন তো?’
অমল শূরের ‘না’ করার কোনও প্রশ্ন ছিল না, করেনওনি।
খাদ্যরুচিতে মহানায়ক ও মহানায়িকার এখানেই পার্থক্য যে, উত্তম কুমারের ঝোঁক কিছুটা বেশি ছিল তামসিক খাবার ও কেতাদুরস্ত ক্যুইজ়িনের প্রতি, কিন্তু সুচিত্রা সেন পুরোপুরি পছন্দ করতেন ঘরোয়া, আটপৌরে ও কম তেল-মশলা দেওয়া খাবার-দাবার।
গত শতাব্দীর আটের দশকে সুচিত্রা সেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল স্বনামধন্য সাংবাদিক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিতাভ চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে। সেই বন্ধুত্ব ছিল ১৯৮০ থেকে ১৯৯০, প্রায় ১০ বছর যাবৎ। এমন বহু দিন হয়েছে, সুচিত্রা সেন হুট করে চলে এসেছেন রানিকুঠির সরকারি আবাসনে অমিতাভ চৌধুরীর ফ্ল্যাটে এবং বলেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের বাড়িতেই দুপুরে খাব। তার পর একটু বিশ্রাম করে বাড়ি ফিরব।’ অমিতাভ চৌধুরীর ছেলে, প্রখ্যাত সাংবাদিক অনির্বাণ চৌধুরী বলছেন, ‘আমাদের বাড়িতে রোজকার রান্না বলতে তখন হতো, ভাত, ডাল, আলু-পটল বা আলু-ফুলকপির তরকারি কিংবা ঝিঙে পোস্ত আর আমিষের মধ্যে রুই মাছের হালকা ঝোল অথবা শীতকালে ফুলকপি দিয়ে কই মাছ। উনি খাবেন বলে এ সবের সঙ্গে কোনও কোনও দিন গোল করে বেগুন কেটে ভেজে দেওয়া হতো। তবে আগে থেকে বাবা ওঁকে নেমন্তন্ন করে রাখলে সে দিন স্পেশ্যাল খাবার-দাবার।’
সেটা কী রকম?
অনির্বাণের কথায়, ‘আমার যতদূর মনে পড়ছে, মাছের একাধিক পদ হতো আর তার মধ্যে একটা অবশ্যই পাবদার সরষে ঝাল। সেই সঙ্গে থাকত চাল আর পটল দিয়ে পোলাও গোছের একটা রান্না আর স্পেশ্যাল কুমড়ো ভাজা। গোল গোল করে কাটা কুমড়োর মাঝখানটা বঁটি দিয়ে কায়দা করে কেটে জানলার শিকের মতো চেহারা দেওয়া হতো। তার পর সেই কুমড়ো ভাজা। উনি ঘরোয়া, হালকা রান্না খুব পছন্দ করতেন।’
সুচিত্রার খুব প্রিয় ছিল শাপলা দিয়ে রাঁধা শুক্তো। সেই শুক্তোয় পড়ত সরষে। আবার সাত-আট রকম আনাজ দিয়ে তৈরি শুক্তোও তিনি খেতেন, তবে তাতে সামাজিক অনুষ্ঠানবাড়ির মতো বড় বড় করে সব্জি কাটা তিনি বরদাস্ত করতেন না। তাঁর শুক্তোয় ছোট ছোট করে কাটা আনাজ পড়ত। আবার কলাপাতায় মুড়ে সেঁকে বানানো পাতুরি তাঁর ভালো লাগলেও তা যে ভেটকি কিংবা ইলিশের হতে হবে, এমনটা জেদাজেদি তাঁর ছিল না। নিরামিষ পাতুরিও তাঁর দিব্যি ভালো লাগত— সরষে ও লঙ্কা দিয়ে আলু মাখিয়ে কলাপাতায় মুড়ে তৈরি পাতুরিও সুচিত্রা সেন খেতেন তৃপ্তি করে। অমল শূর বলছেন, ‘নিরামিষের মধ্যে আর একটা তরকারি ম্যাডাম খেতে খুব ভালো বাসতেন, সেটাও নিজে রান্না করতেন। ওই পদটি হলো, কাঁচকলার কোফতা বানিয়ে অল্প তেল ও হালকা মশলা দিয়ে তৈরি ডালনা। খেতে খুব টেস্টি হতো। মাছের মধ্যে ম্যাডাম যেটা বেশির ভাগ সময়ে খেতেন, সেটা হলো, সাড়ে তিন কেজি-র কাছাকাছি ওজনের কাতলা। ম্যাডামের সর্বক্ষণের সহায়ক অমূল্য গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে ওই মাছ কিনে আনত। সেই কাটা পোনার পাতলা ঝোল তিনি খেতেন অধিকাংশ দিনে। কখনও কখনও ওই ঝোলে পড়ত অল্প সরষে বাটা। শেষ পাতে মাঝেমধ্যেই খেতেন একটা কালোজাম। পান্তুয়া বা লেডিকেনি নয়, কালোজাম। সঙ্গে থাকত দই। মিষ্টি বা টকদই, যে দিন যেটা মনে হতো।’
তা বলে সুচিত্রা সেন যে ঘরোয়া খাবারের বাইরে অন্য কিছু একেবারেই খেতেন না, তা নয়। অমলবাবুর কথায়, ‘বাড়িতে কন্যা মুনমুন থাকলে ম্যাডাম প্রাতরাশে খেতেন ব্রাউন ব্রেডের টোস্ট, অমলেট, অল্প পুডিং আর ব্ল্যাক কফি।’
তবে মহানায়িকা যে সব মাছের সেরা মাছ ইলিশের ফ্যান, সেটা অমল শূর বুঝেছিলেন টালিগঞ্জের চণ্ডী ঘোষ রোডের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয়। সেটা গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের কথা। টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো-পাড়ায় শুটিংয়ের মাঝখানে যাঁরা খাবার রান্না ও পরিবেশন করতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন ননীদা। তা ছাড়া ছিলেন শোভাদা ও খোকাদা। তো, সে দিন দুপুরে ননীদা রান্না করেছিলেন সামান্য সরষে বাটা দিয়ে, চেরা কাঁচালঙ্কা ফেলে ইলিশ মাছের ঝোল। অমলবাবু বলছেন, ‘ম্যাডাম সে দিন ভাত দিয়ে অন্তত গোটা চারেক ইলিশের পেটি খেয়েছিলেন। যেমন ছিল সেই ইলিশের কোয়ালিটি, তেমনই রান্নাটা করেছিলেন ননীদা। ম্যাডামকে বাড়ির বাইরে অত তৃপ্তি করে খেতে আমি আর কখনও দেখিনি।’
তবে একই সঙ্গে সে দিনের জন্য একটা আক্ষেপও রয়েছে অমল শূরের। কী সেটা?
মহানায়িকার পাঁচ-পাঁচটি অসাধারণ ছবির সহকারী পরিচালক বলছেন, ‘সে দিন আমার একটাও ইলিশের পেটি জোটেনি। সব ফুরিয়ে গিয়েছিল। সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল ইলিশের গাদা খেয়েই!’