Advertisement
সুরবেক বিশ্বাস, Nov 1, 2023 Non Fiction Test Tag

তারাদের স্বাদ-আহ্লাদ তৃতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্বে - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার পর পেরিয়েছে দিন কয়েক। এক বিকেলে ৬ নম্বর শরৎ চ্যাটার্জি অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটার তেতলার লিভিং রুমে হালকা গল্পগুজব চলছে পরিবারের সদস্যদের। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের কাছে, মেনকা সিনেমা হল-এর উল্টো দিকের বাড়ি। গৃহকর্তা রবীন্দ্র সরোবর, মানে লেকের দিকে মুখ করে বসে। বাকিরা প্রায় সবাই উল্টো দিকে, তাঁদের চোখ-মুখ ওই ঘরের দরজার দিকে। তেতলার অন্যান্য ঘরে যেতে হলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ওই লিভিং রুমের দরজার কাছাকাছি এসে তবেই বেঁকতে হয়। লেকের দিকে মুখ করে বসেছেন গৃহকর্তা, স্বভাবতই তাঁর দেখতে পারার কথা নয় যে, কে উঠে আসছেন। তার উপর পদচারণা নিঃশব্দ হলে তো বোঝাই সম্ভব নয়। তেমনই চুপচাপ, প্রায় মার্জার-সম নিস্তব্ধতা বজায় রেখে হাতে মিষ্টির একটা বড় হাঁড়ি নিয়ে তেতলায় এসে সেটা রেফ্রিজারেটরে রাখতে যাচ্ছিলেন সনৎ। যিনি গৃহকর্তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী, চালক, সেক্রেটারি— একাধারে অনেক কিছুই।
কিন্তু কী আশ্চর্য! ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের কি মাথার পিছনেও দু’টো চোখ?
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথমে প্রশ্ন করলেন, ‘কে’? তার পরক্ষণেই বললেন, ‘ও, সনৎ।’ ধরা পড়ে যাওয়া গলায়, কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিত স্বরে উত্তর এল, ‘হ্যাঁ, দাদা।’ এর পর দাদার নির্দেশ, ‘ওটা আগে এ দিকে নিয়ে এসো।’ লিভিং রুমে বসা হেমন্তর কন্যা রাণু, জামাই গৌতম-সহ অন্যরা বিস্মিত। এতগুলো বছরের ছায়াসঙ্গী সনতের উপস্থিতি না-হয় তিনি টের পেয়েছেন, তা বলে সনতের হাতে মিষ্টির হাঁড়ি থাকার কথা হেমন্ত কী ভাবে ঠাহর করতে পারলেন?
মিষ্টির হাঁড়িটা এনে সনৎ টি-টেবিলে রাখার পর হেমন্তর প্রশ্ন, ‘কে পাঠিয়েছে?’ সনৎ জানালেন, বিখ্যাত হোমিয়োপ্যাথ চিকিৎসক পি ব্যানার্জি মিষ্টি পাঠিয়েছেন তাঁর পেশেন্ট ও প্রিয় গায়কের জন্য। মিষ্টি মানে হাঁড়ি ভর্তি রসমালাই। তা থেকে এক পিস খেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তৃপ্তিতে মুদে এল চোখ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জামাই গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘ওটা ১৯৮৪-’৮৫ সালের ঘটনা। চমকে গিয়েছিলাম আমরা সবাই। সনৎ মিষ্টি নিয়ে এসেছে, সেটা উনি কী ভাবে বুঝলেন? আমার শ্বশুরমশাইয়ের জুভেনাইল ডায়াবিটিস ছিল। মানে, শৈশবেই উনি ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই, মিষ্টি খাওয়ার উপর ছিল কঠোর বিধিনিষেধ। অথচ যে কোনও মিষ্টি খেতেই উনি ভীষণ ভালোবাসতেন। কতটা, তার প্রমাণ সে দিন বিকেলের ওই ঘটনা। আমার মনে আজও প্রশ্ন, কী ভাবে উনি বুঝলেন যে, সনৎ মিষ্টি নিয়ে এসেছে?’
হেমন্ত-কন্যা রাণু মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘বাবা আসলে ছিলেন মিষ্টির পোকা। মিষ্টি খেতে সাংঘাতিক ভালোবাসতেন। হি ওয়াজ ক্রেজি অ্যাবাউট সুইট্‌স।’
কত বড় গায়ক ও সুরকার ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সে কথা নিয়ে একটা শব্দও এখানে আমার লিখতে যাওয়া কেবল ধৃষ্টতা নয়, মূর্খামিও হবে। তবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বলতে তিনটে মিঠে জিনিসের কথা আমার মনে আসে। মিঠে গলা, মিঠে সুর এবং অবশ্যই মিঠে উচ্চারণ। ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী/তুমি দাও না ও দু’টি আঁখি/ওগো গোলাপ পাঁপড়ি মেলো না/তার অধরে তোমাকে রাখি’-র লিরিক্স অবশ্যই বিস্ময়কর। কিন্তু যে সুরে, যে গায়কিতে, যে গলায় ও যে উচ্চারণে এর উপস্থাপনা, তাতে কোনও সুন্দরকে কি এর চেয়ে বেশি সুন্দর ও মিষ্টি ভাবে সুন্দর বলা সম্ভব? এর সঙ্গে ওই কিংবদন্তি গায়কের কি মিষ্টি-প্রিয়তার কোনও সম্পর্ক ছিল? কে জানে!
মিষ্টি ব্যাপারটা এতই প্রিয় ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে, সাধারণত রোজ রাতে ডিনারের শেষ পাতে তিনি ছানা খেতেন, কিন্তু মিষ্টি-হীন ছানা তাঁর চলত না। অথচ চিনি খাওয়া বারণ তাঁর। অতএব, সেই ছানা স্যাকারিন দিয়ে মাখিয়ে তাঁকে দেওয়া হতো।
হেমন্তর জামাই গৌতম ও মেয়ে রাণু জানাচ্ছেন, মিষ্টি নিয়ে এই বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা বা পাগলামি টুকু বাদ দিলে অন্য কোনও খাবার নিয়ে স্ট্রং লাইকিং বা স্ট্রং ডিজলাইকিং কিছু তেমন ছিল না সুর সাধকের। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন সর্বভুক। খেতে তিনি অবশ্যই ভালোবাসতেন, তবে খুব যে বাছ-বিচার ছিল, তা নয়। যা পেতেন, তা-ই তিনি খেতেন এবং খেতেন খুব কম পরিমাণে। এক রকম স্বল্পাহারীই বলা যায়। তাঁর ট্রেডমার্ক ওই সাদা ধুতি আর সাদা শার্টের সাধারণ পোশাকের মতো তিনি বেশি পছন্দ করতেন সাদামাটা খাবার-দাবার। বেশির ভাগ দিন তিনি প্রাতরাশে খেতেন দুধ-কর্নফ্লেক্স, বিকেল বা সান্ধ্য জলখাবারে বাড়ির তৈরি চিঁড়ে ভাজা। কখনও-সখনও বাড়িতে তেলেভাজা এলে একটা আলুর চপ কিংবা বেগুনি তুলে নিতেন। কেউ তাঁর সামনে তেলেভাজা নিয়ে এলে কিংবা খাবেন কি না, সেটা জিজ্ঞেস করলে তিনি যেন কতটা উদাসীন এমন ভাব দেখিয়ে হেমন্ত বলতেন, ‘দিচ্ছ? দাও তা হলে একটা। খাই।’ ভাজাভুজির প্রতি আসলে তাঁর দুর্বলতা ছিল। লাঞ্চে নিতেন ছোট এক বাটি ভাত, তবে তার সঙ্গে পটল বা বেগুন ভাজা পাতে পড়লে হেমন্ত খুশি হতেন।
প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য কেবল হেমন্ত-মুগ্ধই নন, তাঁর সঙ্গে ওই অবিস্মরণীয় গায়ক-সুরকারের ১০ বছর ধরে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার গানের স্বরলিপি’র সহ-লেখক শঙ্করলাল জানালেন এমন একটা ঘটনার কথা, যা থেকে ওই অসাধারণ গায়কের সাধারণ ও ঘরোয়া খাদ্যরুচি সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হবে।
সেটা ১৯৮৮ সালের প্রথম দিককার কথা। প্রবাসী বাঙালিদের একটি সংগঠনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাগপুর ও মুম্বইয়ে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। মুম্বইয়ের আগে স্টপ নাগপুরে। সেখানে আয়োজক সংগঠনের এক কর্তার বাড়িতে শিল্পী উঠেছেন। সকাল সকাল স্নান করে দুপুর ১২টার বেশ কিছু আগেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘রান্নাবান্না কি শেষ হয়েছে? তা হলে এ বার আমি খেয়ে নেব।’ শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের কথায়, ‘সময়ানুবর্তিতায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন একেবারে ব্রিটিশ। ওঁর স্নান-খাওয়া ছিল একেবারে ঘড়ি ধরা।’ নাগপুরের সেই প্রবাসী বাঙালি বাড়িতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য এলাহি খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। তবে তিনি খেয়েছিলেন কেবল অল্প ডাল, শাকভাজা আর ভাতের বেশির ভাগটা খেয়েছিলেন পারশে মাছের ঝোল দিয়ে। নাগপুরের ওই পরিবার এবং আয়োজক সংগঠনের অন্যরা অবাক। অত রকম মাছ এবং মুরগি ও মাংস রান্না করা হয়েছে, অথচ শিল্পী মেন কোর্স বলতে খেলেন কেবলই পারশে মাছ! গৃহকর্তা ও অন্যরা বাকি খাবার-দাবার নিতে বারবার তাঁকে সাধাসাধি করলেও হেমন্ত বলেছিলেন, ‘না, না, আমার যা খাওয়ার, তা আমি খেয়ে নিয়েছি।’ 
 ইলিশ, চিংড়ি, ভেটকি এবং অন্য সব রকম মাছ খেলেও পারশে ও পাবদা মাছ বিশেষ পছন্দ করতেন হেমন্ত। রুটির চেয়ে এমনিতে বেশি পছন্দ করতেন ভাত খেতে। তবে রাণু মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘বাবা পরের দিকে মাঝেমধ্যে রাতে রুটি-তড়কা খেতে চাইতেন।’ খুব বাহারি খাবার-দাবারের প্রতি মোহ না-থাকলেও সাধারণ খাবারে কখনও-সখনও বৈচিত্র না-পেলে বিরক্ত হতেন হেমন্ত, একঘেয়েমিতে অসন্তুষ্ট হতেন। একবার অসুস্থতার পর তাঁকে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো রোজ খেতে দেওয়া হচ্ছে চিকেন স্টু। টানা সে জিনিস খেয়ে একদিন ফের সেই চিকেন স্টু দেখে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিদ্রোহ করলেন। তখন যেন তাঁর গলায়, ‘এত বিদ্রোহ কখনও দেখেনি কেউ/দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ…।’ শিল্পীর জামাই গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘সে দিন উনি খেপে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সব দিন শুধু চিকেনের স্টু-ই বানাচ্ছে ওরা! আর পারছি না।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খাবার নিয়ে অতিরিক্ত পিটপিটে ছিলেন না। আবার খাবার নিয়ে খুব বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হওয়াটাও ছিল তাঁর ঘোরতর অপছন্দের। গত শতাব্দীর আটের দশকের মাঝামাঝি। সাংবাদিক রানা দাসের প্রশ্ন ছিল, ‘একটা ধারণা আছে, দই খেলে গলা খারাপ হয়ে যায়। তাই, গায়ক-গায়িকাদের অনেকে দই থেকে দূরে থাকেন। সত্যিই কি দই খেলে গলার সমস্যা হয়?’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘একেবারেই ভুল কথা। যে কোনও ঠান্ডা জিনিস খেলে অনেকেরই গলা বসে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়ার ধাত থাকে। দই বলে নয়, যে কোনও ঠান্ডা জিনিসই তাদের এড়িয়ে চলতে হবে। তবে এমনিতে সবারই টক দই খাওয়া উচিত। পেটের পক্ষে, শরীরের পক্ষে ভালো। যাদের ঠান্ডা লাগার সমস্যা, তারা ঠান্ডা টক দই কিছুক্ষণ রেখে তার পর খাবে।’ 
মুম্বইয়ের পশ্চিম খার-এ হেমন্তর তিনতলা বাংলো ‘গীতাঞ্জলি’-তে বহু বছর ছিলেন হরিদা। তাঁকে শুধু কুক বা রাঁধুনি নয়, বলা যায় শেফ। গৌতম বলছেন, ‘হরিদা যা মাটন আর চিকেন বিরিয়ানি বানাতেন, অত ভালো বিরিয়ানি আমি খুব কম খেয়েছি। হরিদার হাতে যেন জাদু ছিল। গুরু দত্ত, শক্তি সামন্তর মতো বেশ কয়েক জন সেলিব্রিটির বাড়ির রাঁধুনিদের কাছ থেকে কিছু রান্না শিখে নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করেছিলেন হরিদা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রকম পদ তিনি দুর্ধর্ষ রাঁধতেন। পোনা মাছের ঝোল-ঝাল থেকে শুরু করে বেক্‌ড বা গ্রিল্‌ড ভেটকি, সব রকম রান্নাতেই হরিদা ছিলেন ওস্তাদ।’ 
বাড়িতে এত ভালো রান্না পেলে কার আর বাইরে রেস্তরাঁয় গিয়ে খেতে ভালো লাগে?
তবে হরিদার রান্না পেতেন বলে নয়, রেস্তরাঁয় গিয়ে খাওয়ার ব্যাপারেই সম্ভবত এক রকম অ্যালার্জি ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। নিজের বাড়ি ছিল তাঁর কমফর্ট জ়োন, বাড়ির খাবার ছিল তাঁর কমফর্ট ফুড। এর ব্যতিক্রমও অবশ্য ছিল। শরৎ চ্যাটার্জি অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই আসত বিজলী গ্রিলের ফিশ ফ্রাই। গরামগরম সেই ফ্রাই আনা হয়েছে আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে?’ কন্যা রাণু জানালেন, ফিশ ফ্রাই। তখন হেমন্ত বলতেন, ‘দেখি, আমিও একটা খাই।’ বিজলী গ্রিলের ফিশ ফ্রাইয়ের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি।
এমনিতে রেস্তরাঁ-বিমুখ হলেও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কলকাতার যে রেস্তরাঁর খাবারের তারিফ সব চেয়ে বেশি করেছেন, সেটা হলো শরৎ বোস রোডের ‘ম্যান্ডারিন’ রেস্তরাঁ। সেখান থেকে গ্রেভি নুডল্‌স, ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন, প্রন বলের মতো আইটেম আসত তাঁর বাড়িতে। তবে তিনি সব চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন ম্যান্ডারিন-এর গ্রেভি নুডল্‌স আর চিকেনের কোনও শুকনো প্রিপারেশন খেতে। সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্যকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেশ পরিতৃপ্তি নিয়ে বলেছিলেন, ‘চিনে খাবারটা কিন্তু ভালো!’
সে দিক থেকে বলা যায়, হেমন্তকে ঘর থেকে রেস্তরাঁ-মুখী করেছিল ম্যান্ডারিন। যার মালকিন, প্রবীণা মনিকা লিউ নিজে এক জন চৈনিক।
 


No Comments Available

Post a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Now