‘কপালকুণ্ডলা’ দেখতে কেমন? এ প্রশ্ন শুনে অনেকেই থমকে যাবেন। বলবেন, সে বর্ণনা তো বঙ্কিম দিয়েছেন তাঁর উপন্যাসে। নবকুমারের চোখ দিয়ে পাঠকেরা দেখেছেন তাকে। সমুদ্রের তীরে সেই অপূর্ব সুন্দরীকে দেখে নবকুমারের বিহ্বল অবস্থা। এ যেন মানবী নয় – চিত্রপটে আঁকা অপরূপা। তখন এদেশের দেশিয় শিল্পীরা ক্যানভাসে বিদেশি শিল্পীদের মতো প্রাকৃতিক শোভা ও প্রতিকৃতি আঁকতে পারতেন না, সে কৌশল রপ্ত হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে শব্দ দিয়ে সেই ছবি আঁকছেন। সমুদ্রতীরে নবকুমার। মুগ্ধ হয়ে স্থান-কাল বিস্মৃত অবস্থায় জলরাশি দেখছেন। অন্ধকার নেমে এল। তখন নবকুমার কাপালিকের পর্ণকুটিরে ফেরার উদ্যোগ করলেন। সমুদ্রের দিকে পিছন ফিরে তিনি দেখতে পেলেন, ‘সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া, অপূর্ব্ব রমণীমূর্ত্তি।’ সেই রমণীই কপালকুণ্ডলা।
তবে প্রশ্ন রমণী ‘কপালকুণ্ডলা’-কে নিয়ে নয়, প্রশ্ন ‘কপালকুণ্ডলা’ বইটিকে নিয়ে। বই নামক সাংস্কৃতিক পণ্যটি তখন বঙ্গদেশে আত্মপ্রকাশ করেছে। সেকেলে পাঠশালা-মক্তবের মুখে মুখে পড়ার রীতি অতিক্রম করে ‘ভার্নাকুলার স্কুল’ প্রতিষ্ঠা হওয়ার ফলে বিদ্যালয়ে ছাপা বইয়ের প্রবেশ ঘটছে। একদিকে যেমন পড়ার বইয়ের নির্মাণ শুরু হল তেমনি শুরু হল পড়ার বইয়ের বাইরের বইয়ের নির্মাণ। বটতলার ছাপা ও ছবিতে ভদ্রলোকদের মন ভরছে না। ভদ্রলোকেরা যে বইকে সাংস্কৃতিক পণ্য হিসেবে ঘরে রাখতে চান সে বইয়ের চেহারা ভাল হওয়া চাই – ছাপা, পাতা এসব ভাল না হলে ভদ্রলোকেরা বই কিনবেন কেন? কথা সেই ‘কপালকুণ্ডলা’ বইটিকে নিয়ে।
বঙ্কিমচন্দ্রের এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হয়নি। সরাসরি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের নতুন রকমের কাহিনি আস্বাদনের সুযোগ ঘটল। এর আগে ‘দুর্গেশনন্দিনী’-তে বঙ্কিম বাঙালি পাঠকদের হৃদয়হরণ করেছিলেন। এ উপন্যাসটি ‘দুর্গেশনন্দিনী’র থেকেও কাব্যময়। পরবর্তীকালে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে যখন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্র প্রকাশিত হল তখন সেই পত্রের নিয়মিত লেখক ছিলেন অক্ষয়চন্দ্র সরকার। অক্ষয়চন্দ্রের পিতা গঙ্গাচরণ সরকার ছিলেন আইনজীবী। বাংলা বইপত্র কেনার শখ ছিল তাঁর। ‘পিতা-পুত্র’ নামের স্মৃতিকথায় পুত্র অক্ষয়চন্দ্র সরকার জানিয়েছিলেন ভাল বাংলা বই প্রকাশিত হলেই পিতা গঙ্গাচরণ তা ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য ক্রয় করতেন। শুধু কিনে সাজিয়ে রাখা উদ্দেশ্য নয়। বই পড়া হত। ব্যক্তিগত একক পাঠ মাত্র নয় – নতুন কেনা বই একজন পড়তেন অন্যরা শুনতেন। ছাপা বইকে ঘিরে পড়া-শোনার সভা বসত। অক্ষয়চন্দ্রের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে গঙ্গাচরণ ‘কপালকুণ্ডলা’ কিনেছিলেন। পিতা-পুত্র লোফালুফি করে সে বইয়ের রসাস্বাদন করেছিলেন। কেবল ‘কপালকুণ্ডলা’ই যদি বঙ্কিমের একমাত্র রচনা হত, অক্ষয়চন্দ্রের মতে তাহলে ‘কপালকুণ্ডলার কবি’ হিসেবেই তিনি অমরত্ব লাভ করতেন।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে সেই ছাপা বইটি দেখতে কেমন ছিল? ‘কপালকুণ্ডলা’-র প্রথম সংস্করণ দুর্লভ – একালের পাঠকদের পক্ষে দেখা প্রায় অসম্ভব। প্রয়াত বঙ্কিম গবেষক মৃদুলকান্তি বসু বোধকরি প্রথম সংস্করণ দেখেছিলেন, নিশ্চিত নই। তবে ‘কপালকুণ্ডলা’-র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রযুক্তির আশীর্বাদে আমপাঠক দেখতে পারেন – হাতে নিয়ে নয়, অন্তর্জালের পর্দায় অথবা ডাউনলোড করার পর ব্যক্তিগত স্ক্রিনে – চাইলে প্রিন্ট আউটও নিতে পারেন। তাতেই দুধের স্বাদ পুরোটা না-হলেও অনেকটা পাওয়া যাবে। ‘কপালকুণ্ডলা’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ‘নূতন সংস্কৃত যন্ত্র’ থেকে। প্রকাশকাল ১৯২৬ সং বৎ অর্থাৎ ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ। প্রথম সংস্করণ প্রকাশের বছর চারেক পরে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত। মূল্য এক টাকা। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ‘এক টাকা’ মানে কিন্তু বেশ দামি। তবে হরফের সাঁট, পাতার চারদিকে সাদা ছাড়, হরফের আকার, দু-লাইনের মাঝের ছাড় সবই চোখের পক্ষে খুবই আরাম-দায়ক। তখন তো ছাপা হত লেটার প্রেসে, একেকটি পাতা যে কী যত্ন নিয়ে মনোযোগ দিয়ে সাজাতে হত।
এক টাকা দামের কপালকুণ্ডলা কেনার সামর্থ বটতলার পাঠকদের ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র জানতেন তাঁর উদ্দিষ্ট পাঠক শিক্ষিত ভদ্রলোক। তাঁরা বইয়ের জন্য সেকালে এক টাকা খরচ করতে প্রস্তুত। প্রায় সমকালে প্রকাশিত হরিশ্চন্দ্র তর্কালঙ্কার সঙ্কলিত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ (১৮৬১) প্রকাশিত হয়েছিল বিদ্যারত্ন যন্ত্রে, মূল্য দুই আনা। হরফের আকার ছোট – সাদা ছাড়, পাতার মাপ, দুই লাইনের মধ্যবর্তী ফাঁক চোখের পক্ষে আরামদায়ক নয়। বিজ্ঞাপনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বইটি শোভাবাজার বটতলার গার্হস্থ্য বাঙ্গালা পুস্তক সংগ্রহের পুস্তকালয়ে পাওয়া যাবে। এই বইয়ের পাঠক আর ‘কপালকুণ্ডলা’ বইয়ের পাঠক এক নয় – ‘কপালকুণ্ডলা’র পাঠক নিতান্ত গার্হস্থ্য কাহিনি পড়বেন না। ইংরেজি শিক্ষিত সেই পাঠক শেক্সপিয়রের ‘দ্য টেম্পেস্ট’ ও ‘ওথেলো’ পড়েছেন। তাঁরা বাংলাভাষায় সমুদ্রতীরবর্তী নিভৃতবাসিনী কপালকুণ্ডলার কথা জানতে চান। নবকুমার সন্দেহপরবশ হয়ে তাঁকে খুন করলেন কি না দেখতে চান। সে বই যেমন-তেমন করে ছাপলে চলবে কেন? ছাপা হয়েছে তাই গভীর মনোযোগ ও যত্ন সহকারে। নিচের ছবিতে কপালকুণ্ডলার আখ্যাপত্র, একটি পৃষ্ঠার অংশবিশেষ ও বটতলার গার্হস্থ্য পুস্তকের নিবেদন অংশ রাখা হল। তুলনা করলেই দু-য়ের পার্থক্য চোখে পড়বে।
বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাই কেবল পাঠকরুচির বদল ঘটাচ্ছে না, বইয়ের ছাপার বৈশিষ্ট্যও পাঠকরুচির পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি থেকে প্রয়াত অধ্যাপক অলোক রায়ের সম্পাদনায় বঙ্কিমচন্দ্রের যে রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে তাতে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের অলঙ্করণ হিসেবে ব্যবহৃত কাঠখোদাই ছবি চোখে পড়ে – ‘কপালকুণ্ডলা’য় অলঙ্করণ হিসেবে কোনও কাঠখোদাই ছবি নেই। একদিক থেকে তা পাঠকের পক্ষে স্বস্তিদায়ক। কারণ প্রকৃতি ও রমণীরূপের যে শব্দচিত্র বঙ্কিমচন্দ্র এঁকেছিলেন তা কাঠখোদাই ছবিতে প্রকাশ করা অসম্ভব। একমাত্র ওয়েল বা ওয়াটার কালার অলঙ্করণ যথাযথ হত। সেভাবে অলঙ্করণ তখন অসম্ভব। সমরেশ বসুর সঙ্গে বিকাশ ভট্টাচার্যের যুগলবন্দী ‘দেখি নাই ফিরে’। তেমন কোনও যুগলবন্দী সংস্করণ ‘কপালকুণ্ডলা’র জন্য কোনও বাঙালি প্রকাশক ভাবেননি। তাই বঙ্কিমের লেখার শব্দে বাঙালি পাঠক মন হারান কিন্তু ‘কপালকুণ্ডলা’র এমন কোনও চিত্রিত সংস্করণ বাঙালি পাঠকের হাতে আসে না। এ পাঠকেরই দুর্ভাগ্য।