দেশ কোথায় চলেছে? কে জানে? এ-দেশে এই মুহূর্তে দুই বিরোধী শক্তির লড়াই আপাতদৃষ্টিতে প্রবল। একদল প্রগতিশীল পশ্চিমমুখো, অন্যদল রক্ষণশীল স্বদেশমুখো। তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে ভারতমুখো রক্ষণশীলরা যে কেন্দ্রীয় হিন্দুত্বের ধারণা তৈরি করছে তা আদতে দেশজ নয়। পশ্চিমী প্রগতিশীলতা ও ভারতীয় রক্ষণশীলতার মধ্যে এই আপাত লড়াইয়ের সূত্রপাত উনিশ শতকে। ‘ভারতী’ পত্রিকায় শ্রাবণ ১২৮৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘গঞ্জিকা অথবা তুরিতানন্দ বাবাজির আক্ড়া’ – অস্বাক্ষরিত রচনা। সেকালের সাময়িক পত্রে একালের মতো লেখকের নাম ও ছবি সবসময় বড়ো বড়ো করে ছাপা হত না। নাম ছাপা হত লেখার তলায়, কোনও কোনও লেখা আবার লেখকের নাম-বিহীন। নাম না থাকার নানা কারণ। প্রথমত, লেখায় কেবল লেখক নয় অনেক সময় সম্পাদকের হাত থাকত। যেমন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রে ১৮৭২ এ অক্ষয়চন্দ্র সরকারের ‘উদ্দীপনা’ নামের লেখাটি বঙ্কিমের হাত যশে পরিণত রূপ লাভ করেছিল। লেখা সেখানে লেখকের নাম ছাড়াই ছাপা হয়েছিল।
‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই ‘গঞ্জিকা’ নামের লেখাটির উপর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্ত’ চরিত্রের প্রভাব ছিল। কমলাকান্ত নামে আফিমখোর এক সত্যবাদী চরিত্রের নির্মাণ বঙ্গদর্শনের পৃষ্ঠায় বঙ্কিম করেছিলেন। তবে প্রভাব মাত্রেই অনুকরণ নয়। বঙ্কিমের কমলাকান্ত ডি কোয়েন্সির ‘ওপিয়াম ইটার’-এর মতো বিশেষ দৃষ্টির অধিকারী। আফিমের মাত্রা একটু বেশি হলেই কমলাকান্ত যা নয় তাই দেখত। সে দেখা যে প্রায় দিব্যদৃষ্টি তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। দিব্যদৃষ্টিধারী কমলাকান্ত যা দেখত তা সত্য – তবে সত্য তো আমরা সব সময় বলতে পারি না, কমলাকান্ত পারত। সত্যকথা বলার জন্য ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত কমলাকান্ত সাহেবি কোম্পানির চাকরি হারিয়েছিল। সাহেব তাঁকে মাসকাবারের পে-বিল তৈরি করতে বলেছিলেন। কমলাকান্ত একটি কার্টুন আঁকলে। এক সাহেব সমস্ত টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন আর পেছনে ভিখিরির মতো নেটিভদের দিকে কয়েকটা পয়সা ফেলে দিচ্ছেন। তলায় লেখা হল যথার্থ পে বিল। বুঝতে অসুবিধে হয় না শিল্পবিপ্লবের পর উপনিবেশপন্থী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরে ইংল্যন্ডের মহারানি কীভাবে ভারত-দোহন করছেন এ তারই ছবি। এমন সাহেব চটানো সত্যবাক্য লিখলে কি কমলাকান্তের চাকরি থাকে? থাকেনি। বঙ্কিম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সাহেবি শর্ত মেনে চাকরি করতেন। সব কথা বলতে-লিখতে পারতেন না। কমলাকান্তকে দিয়ে বলাতেন। শুধু সাহেবদের নয়, দেশজদেরও আফিমের প্রসাদে কমলাকান্ত একহাত নিতে ছাড়ত না। বাঙালি লেখকদের কমলাকান্ত কী চোখে যে দেখেছে!
ঠাকুরবাড়ির ‘ভারতী’ পত্রে প্রকাশিত ‘গঞ্জিকা’ লেখাটিতে অবশ্য কমলাকান্তের ওপর আফিমের প্রভাবের মতো গাঁজার প্রভাবে জেগে ওঠা কোনও সত্যপ্রিয় চরিত্রের কল্পনা অবশ্য করা হয়নি। কমলাকান্তের আফিম উপকারী। আফিমের প্রসাদে কমলাকান্ত সত্য কথা বলে। সে সত্য নিজের সম্বন্ধেও বলতে ছাড়ে না। ‘ভারতী’র গাঁজা সত্য বলতে শেখায় না, মিথ্যে মোহে আবিষ্ট করে রাখে। এই লেখাটিতে নানা রকম গঞ্জিকাসেবীর বিবরণ আছে। তার মধ্যে দু-দলকে বেশ একালের মতো লাগে। একদল গাঁজাখোর ‘বিলাতরঞ্জন গঞ্জিকা’ সেবী। তারা কী করে?
ভারতী উবাচ: ‘ইহার ধূমপান করিলে ইংরাজি অথবা ইঙ্গবঙ্গ বুলি, সময়-সংক্ষেপ রকমের চাল্ চোল্; ব্যক্তিবিশেষকে চমক্ লাগাইয়া ঘড়ি-ঘড়ি উদ্ঘাটন, ধূমায়মান চুরট্ কামড়াইয়া ধরিয়া এবং মধ্যে মধ্যে তর্জ্জনী ও মধ্যমা এই দুই অঙ্গুলির যোগে তাহাকে মুখ হইতে নাবাইয়া, ইংরাজি ঢঙের কথোপকথন দ্বারা লোকজনকে চকিতের জন্য আপ্যায়িত করা ...।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে যে ফ্যাশনেবল ইঙ্গ-বঙ্গের ছবি এঁকেছিলেন এ তারই পূর্বরূপ। এদের বিপরীতে রয়েছে ‘ভারতরঞ্জন গঞ্জিকা’ সেবীর দল। কেমন তাদের চেহারা?
পুনশ্চ ভারতী: ‘পান করিলে লোকের মুখে যেরূপ অসামান্য বল-বিক্রম তেজ করিয়া উঠে’ ভারতরঞ্জন গঞ্জিকাসেবীরা তেমনই বল বিক্রমের অধিকারী।
এই যে বিলাতরঞ্জন গেঁজেলদের সঙ্গে ভারতরঞ্জন গেঁজেলদের লড়াই শুরু হল তা সমানে চলছে। ভারতরঞ্জন আর বিলাতরঞ্জনদের কিন্তু তলায় তলায় একজায়গায় প্রবল মিল। ভারতরঞ্জনরা কথায় কথায় আর্যামির দোহাই দেন। এই আর্যামির দোহাই দেওয়া আসলে বিলিতি কায়দার অনুরূপ। ভারতবর্ষে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রিকতার ব্যামো আদিকালে ছিল না। প্রথমত বেদ রচয়িতারা যে ভারতের আদি জনগোষ্ঠী নয় তা তো প্রমাণিত সত্য। তারা হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর্যামির ব্যামো যখন জেগে উঠেছিল তখন হরপ্পা সভ্যতার খবর জানা ছিল না, সে খবর বিশ শতকে খননের ফলে আবিষ্কৃত। ভারতবর্ষে নানা ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর পাঁচমিশেল। ধর্মের নানা সম্প্রদায়। এই পুরনো ভারতকে ঔপনিবেশিক সাহেব পণ্ডিতেরা হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ এইভাবে স্তরে স্তরে ভাগ করে দিল। ভাবখানা এমন পুরনো ভারতে হিন্দুযুগের কেন্দ্রীভূত ধারণা ছিল, তারপর রাজনৈতিক ইসলামের আগমনে সেই কেন্দ্রীভূত শক্তির পরাভবের ফলে মুসলমান যুগের উত্থান। এই পুরোটাই বিলেতের ইতিহাসবিদদের নির্মাণ, সেই নির্মাণ বিলাতরঞ্জন গঞ্জিকাসেবীদের মধুর লেগেছিল। ভারতরঞ্জন গঞ্জিকাসেবীরা সেই কেন্দ্রীকরণের ভাবনা পুরনো ভারতের ওপর চাপিয়ে দিলে।
গাঁজার দম যদি উনিশ শতকেই ফুরিয়ে যেত তাহলে বেশ হত।
সে দম ফুরোয় না। এখন ভারতরঞ্জনের দোহাই দিচ্ছে যারা তারা নিজেরাও জানে না তারা আসলে বিলাতরঞ্জনের দাস! ভারতরঞ্জনের দোহাই দিয়ে হিন্দুত্বের কেন্দ্রীভূত একমুখী রূপ তৈরির চেষ্টা চলছে। পুরনো ভারতের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে এর মিল নেই।
গঞ্জিকার ধোঁয়ায় চারপাশ ক্রমে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে।
বিলাতরঞ্জন আর ভারতরঞ্জন দুরকম গাঁজার থেকেই বাইরে আসার চেষ্টা করতে হবে।
এটি পাঠকের দারুণ প্রাপ্তি। খুব ভালো পরিকল্পনা।
সুন্দর লেখা। বহুবার পড়া বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাটি ।এখানে সেটিকে ছুঁয়ে বর্তমানের নতুন প্রলেপ যথেষ্ট মনোগ্রাহী লেগেছে আমার ।