Advertisement
Indira Mukhopadhyay, Sep 25, 2023 Non Fiction Test Tag

প্রবাদে প্রবচনে - ২

দুটি অতি পরিচিত সংস্কৃত প্রবাদ বাংলায় বহুল প্রচলিত আজো

"এহো বাহ্য আগে কহো আর"

এ প্রবাদের উৎসমূলে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীভিত্তিক এক আকর গ্রন্থ । শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরজিত শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের মধ্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদের শ্লোকে এই উক্তির অবতারণা। রায় রামানন্দ এবং চৈতন্যদেবের সাধন তত্ত্ব আলোচনার কথোপকথনে উঠে এসেছে সেই বাক্য। একবার নয়। একাধিক বার। পরে এটিই প্রবাদে পরিণত। সাধ্য বলতে বোঝায় কাম্য বস্তু। সাধন হল সেই সাধ্যবস্তু লাভের পদ্ধতি।

সন্ন্যাস গ্রহণের পরে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের গোদাবরী তীরে রায় রামানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতকালে ধর্ম তত্ত্বের আলোচনা হয়। রায় রামানন্দ বিষ্ণুপুরাণ থেকে উল্লেখ করে বলতে থাকলেন। প্রথমে বললেন, "স্বধর্মাচরণে বিষ্ণুভক্তি" র কথা। প্রত্যেক জীব নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাসে ভক্তিময়তায় আবিষ্ট থাকে। একাগ্রচিত্তে উপাসনায় তন্ময় থাকলে ঈশ্বর কে পাওয়া যায়।

চৈতন্যদেব রামানন্দের কথার গুরুত্ব না দিয়ে বললেন “এহো বাহ্য, আগে কহ আর” অর্থাৎ এটি বাহ্য বিচার, আমার প্রশ্নের উত্তর এই বিচার অতিক্রম করে আরও ঊর্ধ্বে যা আছে, তা বল। আবারো রামানন্দ বললেন সেই তত্ত্বকথা... "কৃষ্ণে কর্মাপণ সাধ্যসার"

মহাপ্রভুর ভাবখানা, এ আর নতুন কী? এ তো সকাম ভক্তির লক্ষ্মণ। আরো আগে বাড়াও। অন্য কিছু বলো। “এহো বাহ্য, আগে কহ আর।”

এবার রামানন্দ বলেন, "স্বধর্মত্যাগ এই সাধ্যসার"

মহাপ্রভু বলেন, এ তো নিজধর্মের প্রতি অকর্তব্যপরায়ণতার কথা। নতুন কিছু বলো হে। “এহো বাহ্য, আগে কহ আর।”

আবারো রামানন্দ বলেন, "জ্ঞানমশ্রাভক্তি সাধ্যসার"

মহাপ্রভু এসব শুনতে নারাজ। বলেন অন্যকথা শুনতে চাই। “এহো বাহ্য, আগে কহ আর।”

"জ্ঞানশূন্য ভক্তি সাধ্যসার" পঞ্চম স্তরে এমন বললেন রামানন্দ। তখনো মহাপ্রভু এ পন্থা কে কিছুটা স্বীকার করে বললেন “এহো হয়, আগে কহ আর।” মহাপ্রভু স্বীকার করলেন,–এখন সাধ্য নির্ণীত হল বটে, কিন্তু আরও ঊর্ধ্বে যা আছে বল।

এরপর রামানন্দ বললেন, "প্রেম ভক্তি সর্বসাধ্যসার"

সেইশুনে চৈতন্য মহাপ্রভু বিগলিত হয়ে বললেন, “এহো হয়, কিছু আগে আর।”

রামানন্দ রায় বললেন, “সখ্য-প্রেম–সর্ব-সাধ্যসার।”

মহাপ্রভু বললেন, “এহো উত্তম, আগে কহ আর।”

রামানন্দ রায় বললেন, “বাৎসল্য-প্রেম–সর্ব-সাধ্যসার।”

মহাপ্রভু বললেন, “এহো উত্তম, আগে কহ আর।”

অর্থাৎ এসব তত্ত্বকথা সবার জানা। এমনটাই ভাব তাঁর।

আদতে আমাদের ব্যাবহারিক জীবনে আমরা এমন কথোপকথনের সাক্ষী থাকি বৈকি। বিশেষত পুলিশ বা উকিলের সামনে গুরুতর অপরাধী জেরার মুখে কিম্বা ছোট্ট শিশু শিক্ষক বা অভিভাবকের প্রশ্নের সামনে পড়লে নানাবিধ তানাবানায় মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে এই প্রবাদ আজো আমাদের কথায় কথায় উঠে আসে। অথবা কেউ হয়ত কোনো আলোচনায় চর্বিত চর্বণ উপাখ্যানের অবতারণা করেই চলেছেন তখন তাঁকে বলা হয় "এহো বাহ্য আগে কহো আর"

 

"প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ"

এই সংস্কৃত প্রবাদের মূলে সেই বিখ্যাত শ্লোক।

"হবির্বিনা হরির্যাতি

বিনা পীঠেন মাধবঃ।

কদন্নৈঃ পুণ্ডরীকাক্ষঃ

প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ।।

সংস্কৃতে চার পংক্তির এই শ্লোকের মাধ্যমেই জামাই বিতাড়ন কাহিনী বর্ণিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। যার অর্থ হল

ঘৃতের অভাবে হরি চলে গেলেন,পীড়া অর্থাৎ কাষ্ঠাসনের অভাবে চলে গেলেন মাধব, কদর্য অন্ন দেখে পুণ্ডরীকাক্ষ এবং ধনঞ্জয় গেলেন প্রহারের ফলে।

পুরাকালের বাঙালীর সমাজ জীবনে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার জীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল যেনতেনপ্রকারেণ কন্যাটি কে পাত্রস্থ করা। পাত্র যদি অলস, কুঁড়ে বা কর্মহীনও হত তাহলেও পাত্রীর অভাব হত না। উপার্জনহীন জামাতা শ্বশুরঘরেই প্রতিপালিত হতেন। এই জামাইষষ্ঠীর প্রাক্কালে এ যুগেও এই প্রবাদের খুব রমরমা চালু আছে। সেকালে দরিদ্র কোনও জামাই জামাই ষষ্ঠী উপলক্ষ্যে একবার শ্বশুরালয়ে যাবার সুযোগ পেলে সহজে আর নিজগৃহে প্রত্যাগমনের নাম করতেন না। জামাই ছেলের মত। অতএব নিজের ইচ্ছায় বাড়ি না গেলে তাঁকে তো আর জোর করে, ঘাড় ধরে বাড়ি পাঠানো যায় না। এদিকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অবস্থা জামাই বিদায় হলেই বাঁচি। কারণ জামাই বলে কথা। তাঁর জন্য আয়োজন সামান্য হলেও গেরস্থের ঘরে মহার্ঘ আর দিনের পর দিন তা বড়ই চাপের। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সহ্যশক্তির মাত্রা লঙ্ঘন বা করে জামাই বিতাড়নের নানা কৌশল অবলম্বন করতেই হত।

কন্যাদায়গ্রস্ত এক গৃহস্থ তার চার কন্যাকে নিরূপায় হয়ে চার দরিদ্র পরিবারে পাত্রস্থ করেছিলেন। তিনি ছিলেন ছিলেন পরম বৈষ্ণব। তাই বিষ্ণুর নামের চার পাত্রদের পেয়ে মহাখুশি তিনি। হতদরিদ্র এই চার জামাইদের মধ্যে বড় হলেন হরি, মেজো জামাই মাধব, সেজোর নাম পুণ্ডরীকাক্ষ এবং ছোটো জামাইয়ের নাম ছিল ধনঞ্জয়। জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণে একবার সপরিবারে শ্বশুরালয়ে প্রবেশের সুবর্ণ সুযোগ হল তাদের। মহা সমারোহে জামাই ষষ্ঠী পালন হল। কিন্তু চারজনের কেউই নিজের বাড়ি ফেরার কথা মুখে আনেনা। দিব্য খায়দায় আর অলস জীবন যাপন করেই চলে। এদিকে দিনের পর দিন জামাই আদর প্রাপ্তিতে তাদের মন কানায় কানায়। ওদিকে দিনের পর দিন শ্যালকদেরও ব্যাপারটা ভালো লাগে না। পাড়া প্রতিবেশীও কানাঘুষো করে। লজ্জায় পড়েন গৃহস্থ। অতএব বিহিতের কথা মাথায় রাখতেই হয় তাঁকে।

এদিকে আহার, নিদ্রা, মৈথুনে ঘাটতি নেই। জামাইরা ভাবেন এই বেশ ভালো আছি। বাড়া ভাতে জামাই আদরে। কিন্তু সেবার গৃহস্থের ফসল ভালো হল না। ব্যাবসায় মন্দা। অথচ সে গৃহস্থের বাড়িতে জামাইয়ের গরম ভাতে গব্য ঘৃত, কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি, কাঁসার থালা, গেলাস, বাটি সব উপাচারে খামতি নেই। একে একে জামাই "আচ্ছেদিন", আপ্যায়নের রীতিতে বাধ সাধলেন স্বয়ং শ্বশুরমশাই।

সুগন্ধী, অভগ্ন ফুরফুরে গরম ভাতের মাঝে ঘি না পেয়ে বড় জামাই হরি খুব চটে গেলেন। বাকীরা ঘি ছাড়াই দিব্য খেলেন আর হরি রেগেমেগে শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করলেন।

বিশাল বড় সুদৃশ্য কাঠের পিঁড়ি তে ভাত খাওয়া অভ্যেস হয়েছে তাঁদের। একদিন সেই কাষ্ঠাসন না দেখে মেজো জামাই মাধব বেজায় চটে গেলেন। থালার পাশে যতই পঞ্চব্যঞ্জন থাকুক পিঁড়ির অভাবে তাঁর খাওয়াটাই মাটি। অতএব তিনি না খেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলেন।

বলাই বাহুল্য বাকী দুজন অর্থাৎ পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় মাটিতে বসেই চেটেপুটে সব খাদ্যের গতি করলেন পরম তৃপ্তিতে।

তাদের না চাই ঘি কিম্বা কাঠের আসন। দিন কয়েক বাদে পুণ্ডরীকাক্ষ ও ধনঞ্জয় লক্ষ্য করলেন, তাঁদের দুর্গন্ধযুক্ত পোকা ধরা চালের ভাত দেওয়া হয়েছে। ধনঞ্জয় চুপচাপ খেতে থাকলেও পুণ্ডরীকাক্ষ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, এখানে আহার করা তার পক্ষে নিতান্তই অপমানজনক। সেই মুহূর্তেই পুণ্ডরীকাক্ষ পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করলেন।এদিকে ধনঞ্জয় মাটিতে বসে কদর্য সেই অন্নই শুধুমাত্র এক রকম ব্যঞ্জন সহযোগে খেয়ে চলেছেন। নানা কৌশলেও তাকে বিতাড়ন করতে না পেরে একদিন শেষ চেষ্টা করলেন গৃহস্থ। একে দুর্গন্ধ তায় আবার ব্যঞ্জনহীন। তাই সই। ধনঞ্জয় ভাতের মণ্ড একপ্রকার গিলতে লাগলেন। তাঁর শ্যালকেরা আড়ালেই ছিলেন। তাহারা এসে বেশ কয়েকবার ধনঞ্জয়ের ঘাড় ও গলদেশে একাধিক কিল ও চড় মারতে লাগলেন।

শ্যালকেরা কিল, চড় মারছে তা বড়ই অপমানের। একরাশ অভিমানে ধনঞ্জয় অবশেষে পরিবার সহ শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করলেন।

সেই থেকেই "প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ" প্রবাদটি আজো মুখে মুখে ফেরে। তাই জামাইকে সম্মান এবং আদর পেতে গেলে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে চলা উচিত।
 


Recent Comments

ভজন দত্ত Sep 25, 2023

ভালো লাগলো। আরো আসুক

Post a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

WhatsApp Now