বহবারম্ভে লঘুক্রিয়া
বহবারম্ভে লঘুক্রিয়া প্রবাদের উৎসমূলে পণ্ডিত চাণক্যের বিখ্যাত সংস্কৃত শ্লোকটি মনে পড়ে।
"ঋষি শ্রাদ্ধে অজা যুদ্ধে প্রভাতে মেঘডম্বরে।
দাম্পত্য কলহে চৈব বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া।।
যা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় বনে দেহত্যাগকারী ঋষির শ্রাদ্ধে, দুটি ছাগলের যুদ্ধে, প্রভাতে মেঘের গর্জনে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় শুরুতে খুবই আড়ম্বর হয়, কিন্তু তার ফল হয় অতীব নগণ্য ।
মানে কোনও কাজ খুব ঘটা করে শুরু হয়ত হয় কিন্তু অল্পেতেই শেষ হয়ে যায়। তার ফল অতি সামান্য।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল আমার রন্ধন পটীয়সী দিদিমার হেঁশেল কথা। অন্য কেউ তাঁর হেঁশেলে প্রবেশ করে বেশ অন্যরকমের কিছু বানাতে গেলেই তাঁর মুখেই শুনেছি এই প্রবাদ। রান্নাবান্না ছিল তাঁর বাঁহাতের খেল। তুমুল বাজার দোকান হল একটি মাত্র পদ রাধাঁর জন্য। রান্নাঘর আগলে বসে রইলেন রাঁধুনি। সেখানে অন্য কারোর প্রবেশ নিষেধ রইল। আয়োজন হল রাজকীয়। কিন্তু সবশেষে সেই পদের পরিণতি হল অতীব সামান্য। মানে স্বাদে গন্ধে তা আহামরি কিছুই হলনা। আবার বিশাল কোনও শিল্পকর্ম কিম্বা লেখাপড়ায় শ্রমদান করে অনেকেই প্রাণপাত করে কিন্তু হয়ত সেই অনুযায়ী ফল লাভ হয়না।
কাগজ, ম্যাগাজিনের পাতায় খ্যাতনামা সব ফুড কলামনিস্টদের কথা মনে পড়ল। সারাটা কাগজ জুড়ে রান্নার উপকরণ। বিশাল ছবি। তুমুল আয়োজন। কুকিং টাইম এক ঘণ্টা অথচ সাদামাটা অতিসাধারণ এক রান্নার অপভ্রংশের মত একটা আউটপুট হল যা খেতে মাত্র ৫ মিনিটও ব্যয় হলনা। গালভরা নাম, ছবি, উপকরণেই মাতল সে পদ। হয়ত দেখা গেল সে রান্না আদতেই আমাদের চির পরিচিত জল ঢালা পান্তা ভাত। সঙ্গে আলুভাজা আর বেগুণপোড়া। শেফ তার নামও দিয়ে ফেলেছেন "বাইগন কি কাবাব উইথ ঠান্ডি পুলাও ইন আ বেড অফ ক্রাঞ্চি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ"। তখন এমন প্রবাদ মাথায় আসাটা বিচিত্র কিছু নয়।
চাণক্যের শ্লোকে স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার কথাতে মনে পড়ে গেল আমার নিজের জীবনের একটি মজার কথা। আমার শিশুপুত্রের তখন বছর পাঁচেক বয়স। তার দাদু আর দিদিমার মধ্যে দিনের বেলায় একদিন তোলঘোল বেঁধে গেল সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে। সেই তুমুল বাকবিতণ্ডার সাক্ষী রইল ওইটুকুন শিশু। এবার সারাদিন বেশ থম মেরে রইল দুজনে। পরের দিন শিশুটি অবাক হয়ে দেখল দাদু-দিদিমা আবার গল্প করছে। কথা বলছে আগের মত। তখন সে গিয়ে বলল, "তোমাদের ভাব হয়ে গেছে?"
এসব ঘটনার প্রতিনিয়ত সাক্ষী আমরাই। মুনিঋষিদের শ্রাদ্ধ বা ছাগলের যুদ্ধ নাহয় বাদই দিলাম কিন্তু আকাশে ঘন কালো বজ্রগর্ভ মেঘ আর তার চমকানি এবং ধমকানি দেখে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি না পড়লে আমরাও বলে উঠি বৈকি। "যত গর্জালো তত বর্ষালো না" কিম্বা "সাজতেগুজতে মেঘের দোল ফুরোয়"।
চাণক্য কতদূর অবধি দেখতে পেতেন তাই ভাবছি।
গণ্ডূষজলমাত্রেণ সফরী ফর্ফরায়তে
কথাটিও খুব শোনা যায় এখনও। চাণক্যের মূল শ্লোকটি হল এরূপ।
অগাধজলসঞ্চারী বিকারী ন চ রোহিতঃ
গণ্ডূষজলমাত্রেণ সফরী ফর্ফরায়তে।।
সংস্কৃত এই শ্লোকের অর্থ হল অল্পবিদ্যায় শিক্ষিত ব্যাক্তির হামবড়াই মানায় না। কথাতেই বলে অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। সে এত কম জানে তবুও তার বিদ্যা জাহির করাই চিরকালের অভ্যাস। অথচ যিনি প্রকৃত জ্ঞানী তিনি কিন্তু সঞ্চিত জ্ঞান নিয়ে চুপচাপ থাকেন। নিজের জ্ঞান জাহির করে মহৎ হতে চান না। তাকে তো সবাই চেনে। সবাই তার জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে সচেতন। ঠিক যেমন অগাধজলের বাসিন্দা আমাদের চেনা পরিচিত রুইমাছ। তার কোনও বিকার নেই, ভ্রূক্ষেপ নেই কোনোদিকে। সে নিজের মত ঘুরে বেড়ায় গভীর জলে। তার নতুন করে পরিচিতিরও প্রয়োজন নেই। সে হল মাছের বাজারে চেনা বামুনের মত। তার পৈতে, টিকি কিছুর দরকার হয়না।
খাওয়ার পূর্বে ব্রাহ্মণের হাতের মধ্যে সামান্য এক কোষ জল নেওয়ার রীতি এখনও আছে। মন্ত্রোচ্চারণে অন্ন ঈশ্বর কে নিবেদন করে তবে তিনি মুখে তোলেন। সেই একরত্তি গণ্ডূষের জলেই একরত্তি পুঁটিমাছ সদর্পে লাফালাফি করে জানান দেয় নিজের অস্তিত্ত্বের। যেন সে কত বড় একটা মাছ! রুইমাছের সঙ্গে এই চুনোমাছের তুলনাটি আজও খুব প্রাসঙ্গিক। আমরা আজ সোশ্যালমিডিয়ায় তেমন প্রমাণ প্রচুর পাই হাতেনাতে। এছাড়াও রাজনীতির আঙিনাতেও এমন কি ভুঁইফোড় প্রোমোটারদের চালাকিতেও ধরা পড়ে এমন ঘটনা প্রায়শই। এত সীমিত জ্ঞান, বিদ্যা নিয়ে তাদের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যায় আর আমার মনে পড়ে যায় স্বামীজির সেই অমোঘ বাণী। "চালাকির দ্বারা কোনও মহৎ কাজ হয়না"।
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যিক ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় এই বিষয় নিয়ে সুখবর সংবাদপত্রে যখন লিখেছেন, তখন থেকেই পড়ছি, ভালো লাগছে। এইসব প্রবাদ-প্রবচন দুই মলাটে বন্দি করলে ভালো কাজ হবে।